Tuesday, August 16, 2011

সতেরো আগস্ট - শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার

সন্ধ্যাবেলায় বাবা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে বলল আমাকেই ডায়িং স্টেটমেন্ট নিতে হল। ছেলেটার নাম বাচ্চু চক্রবর্তী, সিপিএম করে। এভাবেই ক্লাস ফাইভের বালক আমার জীবনের সাথে যুক্ত হয় ভাষা আন্দোলনের দ্বাদশ শহীদ বাচ্চু চক্রবর্তীর নাম। তার পরদিনই বোধহয় শিলচর শহরের সেই ঐতিহাসিক শেষ যাত্রা। ভাষা আন্দোলনের সময় প্রতিদিন যেমন আমাদের মিছিলে নিয়ে যাওয়া হত, সেদিনও একইভাবে স্কুল থেকে শেষযাত্রায় নিয়ে যায় ওপরের ক্লাসের ছাত্ররা। তারপর শহরময় শুধু একই আলোচনা, আলোচনা আমার সরকারি আমলা বাবার অন্দরমহলেও। ভাষা আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্যেই এই খুন করা হয়েছে। অবিভক্ত কাছাড় জেলার সর্বত্র ছাত্র সমাজ সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ বাচ্চু চক্রবর্তীকে বরণ করে নিলেন ভাষা আন্দোলনের দ্বাদশ শহীদ হিসেবে। পরের বছর ১৯ শে মে গোটা জেলায় পালিত হল দ্বাদশ শহীদ দিবস হিসেবে। সেদিন বাবার সরকারি গাড়িতে বিলপারে দাদুর বাড়ি যাবার পথে নানা জায়গায় শহীদ বেদি দেখে দেখে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কোথাও কোনও শহীদ বেদিতে দ্বাদশ না লিখে একাদশ লেখা দেখলেই দাদা বলে উঠেছে, বেইমান। বলা বাহুল্য, সেদিন শিলচর শহরে খুব অল্প কয়েকটি বিচ্ছিন্ন জায়গায়ই আমরা একাদশ শহীদ স্মরণে কথাটা লেখা দেখেছিলাম। সারা শহরের অধিকাংশ শহীদ বেদিতেই লেখা ছিল দ্বাদশ শহীদ স্মরণে। বাচ্চু চক্রবর্তীর শহীদত্ব নিয়ে দল-মত নির্বিশেষে প্রায় কারোর মধ্যেই কোনও সংশয় ছিল না। 'প্রায়' কথাটা এজন্যেই লেখা, সে বছর একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের অফিসের ভেতরের শহীদ বেদি ও খুব অল্প কয়েকটি পাড়ার ক্লাবে লেখা ছিল একাদশ শহীদ কথাটি। ওই সময়ে তৎকালীন কাছাড় জেলায় ওই দলের বিরুদ্ধে জনমতের কি প্রবল হাওয়া বইছিল তা পুরোনো লোকেদের নিশ্চয়ই মনে আছে। ১৯৭৪ সালেও ১৯ মে দ্বাদশ শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হল কাছাড় জেলার সর্বত্র। চিত্রটা পাল্টে দিল জরুরি অবস্থা। ১৯৭৫ সালে জরুরী অবস্থার সময়ে ১৯ মে'র আগে ছাত্র পরিষদের পক্ষ থেকে একটি ডিমাই সাইজের লিফলেট বের হয়। সেখানে বড় বড় হরফে লেখা ছিল ১৯ মে একাদশ শহীদ দিবস পালন করুন। বাচ্চু চক্রবর্তীর সহযোদ্ধা ছাত্রনেতারা বা ভাষা সংগ্রামীরা হয় তখন জেলে, নয়ত জরুরি অবস্থার নিষেধাজ্ঞায় প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে অপারগ। ছাত্র পরিষদের তখনকার নেতারা এখন কেউই আর সক্রিয় রাজনীতি করেন না। কিন্তু তারা নিশ্চয়ই কেউ বিস্মৃত হন নি, কিভাবে তারা সেদিন জরুরি অবস্থার সুযোগ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ক্লাবগুলোকে দিয়ে দ্বাদশ শহীদকে ভুলিয়ে দেওয়ার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এখনও মনে আছে, আমাদের বাড়ির বৈঠকখানায় কে জানি বলেছিলেন এক সান্ধ্য আসরে, ইমারজেন্সির সুযোগ নিয়ে কেমন বিকৃত হয়ে গেল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। শুধু শহীদ বেদি নয়, কিছুদিন পর জানা গেল শহীদ বাচ্চুর প্রধান হত্যাকারীরা মুক্ত হয়ে গেছে। ১৯৭৩, ১৯৭৪ সালে যেমন সারা জেলাতেই ১৯ মে পালিত হয়েছিল দ্বাদশ শহীদ দিবস হিসেবে, আর শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবাধীন জায়গায় ১৯ মে ছিল একাদশ শহীদ দিবস, তেমনি ১৯৭৭-পরবর্তী সময়ে হিসেবটা উল্টে গেল। দেখা গেল জরুরি অবস্থায় বাচ্চুকে যেভাবে জনমন থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, তার রেশ রয়ে গেছে। তখন 'দ্বাদশ শহীদ' শব্দবন্ধটি নির্বাসিত হয়ে পড়ল অন্য একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রভাবাধীন জায়গায়, আর উপত্যকার সাধারণ পরিসরে নানা যুক্তি দেখিয়ে ১৯ মে'কে একাদশ শহীদ দিবসে পরিবর্তিত করে দেওয়া হল। আমরা যখন বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত হয়েছি, তখন, সম্ভবত ১৯৮০ বা ১৯৮১ সালে শিলচর শ্মশান ঘাটে শহীদ বেদি নির্মাণকে কেন্দ্র করে আবার বরাকের রাজনীতিতে বাচ্চু চক্রবর্তীর নাম প্রবলভাবে উঠে এল। সন্তোষ মোহন দেবের নেতৃত্বাধীন শিলচর পুরসভা শিলচর শ্মশান ঘাটে দ্বাদশ শহীদ শিলা তুলে দিয়ে একাদশ শহীদ বেদি নির্মাণ করতে গেলে এসএফআই-এর নেতৃত্বে শিলচরে এক তুমুল ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। আমরা শহরের স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বিশাল মিছিল করে তৎকালীন পুরপতি সন্তোষ মোহন দেবের সামনে হাজির হলে, আমাদের জোরালো দাবির উত্তরে তিনি বলেন, বাচ্চুকে আমি শহীদ হিসেবে স্বীকার করি, কিন্তু এ কথাটি বলতে আমার রাজনৈতিক অসুবিধা আছে। আমরা তখন তাঁকে বলি, আপনি বারোটি শিলা তুলে এগারোটি বেদি তৈরি করছেন কেন? তিনি বলেন, বারোটি বেদি তৈরি করারও আমার রাজনৈতিক অসুবিধা রয়েছে। আমাদের জোরালো প্রতিবাদের উত্তরে তিনি খানিকটা চ্যালেঞ্জের সুরে বলেন, তোমরা যদি চাও তো নিজেরা কর না কেন? তোমরা তৈরি করলে আমার আপত্তি নেই। তখনকার এসএফআই নেতা ও বামপন্থী দলীয় নেতারা মুহূর্তের মধ্যে এই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে গেলেন। তখন শিলচর পুরসভায় চারজন বামপন্থী সদস্য ছিলেন। তাঁদের সাথে পরামর্শ করে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই দ্বাদশ বেদি তৈরির কাজে নেমে পড়ি। পুরসভা কর্তৃপক্ষ ভাবতেই পারেন নি যে আমরা এই চ্যালেঞ্জ এভাবে গ্রহণ করতে পারব। তারপরও তারা বাধা দান করলেন এই বলে, দ্বাদশ বেদিটি অন্য এগারোটি বেদি থেকে খানিকটা দূরত্ব রেখে তৈরি করতে হবে। আমরা বললাম, আমরা তাতেও রাজি। আমরা জানতাম, শহীদ বেদির দূরত্ব দিয়ে বাচ্চু চক্রবর্তীর মত ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দান করে শহীদত্ব বরণ করা নেতাকে মানুষের মন থেকে কেউ মুছতে পারবে না। শিলচর পুরসভা কর্তৃপক্ষ স্থির করলেন ১৯ মে একাদশ বেদির আবরণ উন্মোচন করবেন। আমাদেরকেও ওইদিনই বাচ্চু চক্রবর্তীর বেদিটি ওই সময়েই উদ্বোধন করতে হবে এমন জেদ থেকে এসএফআই কর্মীরা রাজমিস্ত্রির সাথে সহায়কের ভূমিকায়ও লেগে গেলেন। পদে পদে বাধা অপমান সত্ত্বেও রাতদিন কাজ করার পর ১৯ মে সূর্যোদয়ের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চু চক্রবর্তীর বেদিটিও তৈরি হয়ে গেল। পুরসভা কর্তৃপক্ষ একাদশ বেদি উন্মোচনের জন্যে শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে দিয়ে শ্মশানের গেট থেকে পদযাত্রা করে শহীদ বেদির কাছে আসার কর্মসূচি নিয়েছিলেন। সকাল থেকে নানা স্তরের শাসক দলের নেতারা আমাদের বারবার বলে আসছিলেন, আমাদের পদযাত্রা এলে ভাই, তোমরা জায়গা ছেড়ে দিও। আমাদেরটা উদ্বোধন হওয়ার পর তোমরা যা করার কোরো। সেদিন এই দাম্ভিকতার মুখে চুন মাখিয়ে দিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষবিদ প্রেমেন্দ্র মোহন গোস্বামী। পুরসভার পদযাত্রাটি নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে আসার সময় প্রেমেন্দ্রবাবু প্রথমেই দাঁড়িয়ে পড়লেন শহীদ বাচ্চু চক্রবর্তীর স্মরণে নির্মিত কিছুক্ষণ আগে শেষ হওয়া শহীদ বেদির সামনে। ফুল দিলেন সেখানে, মাথা নত করে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন শহীদ বাচ্চু চক্রবর্তীর প্রতি। সেই মুহূর্তে আমাদের কাছে এক কত বড় মানুষ হয়ে উঠেছিলেন প্রেমেন্দ্রবাবু এখনও মনে আছে। মনে আছে, আবেগে আমাদের কারো কারো চোখের কোণে তখন জলের রেখা দেখা দিয়েছে। দুঃখ হয় এই ভেবে যে, বাচ্চু চক্রবর্তীই বোধহয় একমাত্র ভাষা শহীদ, যাকে শহীদত্ব বরণ করার পরও বারবার খুন হতে হয়েছে কায়েমী স্বার্থাণ্বেষীদের হাতে। এ জন্যেই বাচ্চু চক্রবর্তীর শহীদ বেদির ফলকের জন্যে বিশিষ্ট শিক্ষক সুহাস রঞ্জন কর বেছেছিলেন এই দু'টি লাইন
বন্ধু, আজকে আঘাত দিও না তোমাদের দেওয়া ক্ষতে
আমার ঠিকানা খোঁজ কোরো শুধু সূর্যোদয়ের পথে।
মনে হয় যেন কবি সুকান্তের এই দুটি পংক্তি শহীদ বাচ্চু চক্রবর্তীর জন্যেই লেখা।
একাদশ দ্বাদশের লড়াই আবার আরেকবার চাগিয়ে উঠল ১৯ মে'র ২৫ বছর পূর্তির সময় ১৯৮৬ সালে। শহরের প্রাজ্ঞজনেরা তখন মতামত দিলেন, একাদশ দ্বাদশ বাদ দিয়ে দিবসটি পালিত হোক ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে। সেই থেকে ১৯ মে'র দিনটিকে বিতর্ক মুক্ত করার এই সমাধানটি মেনে আসছেন সকলেই। এখন গোটা বরাক উপত্যকা জুড়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ১৯ মে'র পাশাপাশি পালিত হয় আরো তিনটি দিন। শহীদ বাচ্চুর স্মৃতিমাখা ১৭ আগস্ট, জগন-যীশুর বলিদানের দিন ২১ জুলাই ও শহীদ সুদেষ্ণার আত্মত্যাগের দিন ১৬ মার্চ।
লড়াই শেষ হয় নি নানা দিক থেকেই। শুধু বাচ্চু চক্রবর্তীর মূল্যায়নই নয়। বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনকে উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজনীতির নিরিখে মূল্যায়নের কাজটি আজও শুরুই হল না। যে বামপন্থীরা ১৯৬১ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরম্ন করে ১৯৭২ সালের ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দান করেছিলেন পরবর্তীতে ভাষা সংস্কৃতির প্রশ্নগুলিকে রাজনৈতিক সংগ্রামের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে কিছু কিছু দোদুল্যমানতা কাজ করেছে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অথচ এ কাজটি বামপন্থীরাই করতে পারেন। অন্যেরা এই উদ্যোগ নিলে সর্বনাশ ছাড়া হওয়ার আর কিছু নেই। উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজনীতির যে একটি সাংস্কৃতিক মাত্রা রয়েছে, সমাজবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে বামপন্থী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলিও আজ এই কথা বলছেন। কিন্তু ব্যবহারিক রাজনীতির ক্ষেত্রে এই নীতির প্রয়োগ এখনও আমরা দেখতে পাই নি। এই উদ্যোগ যদি কখনো গ্রহণ করা হয়, তখন বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনকে উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে দেখে এর যথার্থ মূল্যায়ন করার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। শহীদ বাচ্চু চক্রবর্তী শুধু একজন ভাষাসৈনিক ছিলেন না, ছিলেন বামপন্থী যুব আন্দোলনের একজন প্রথম সারির নেতা। গুয়াহাটির একটি সভায় তাঁর ভাষণ শুনে আসামের বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য কমিউনিস্ট নেতা অচিন্ত্য ভট্টাচার্যকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, অচিন্ত্যবাবু, কাছাড়ে আপনাদের দলে এমন ছেলে আর ক'জন আছে? যদি একাধিক থাকে, তবে সেখানে আপনাদের দলের ভবিষ্যৎ যে উজ্জ্বল, তা বলতে পারি। এমন একজন নেতার মৃত্যুবার্ষিকী থেকেই তো বামপন্থার সাথে ভাষা রাজনীতির একটি সংলাপ রচনার সূত্রপাত হতে পারে। এখন সময়টা বড় খারাপ। দূর থেকে ইন্টারনেটের পাতায় খবর পড়েও বুঝতে পারি উত্তর পূর্বাঞ্চলের আকাশে অনেক শকুন উড়ে বেড়াচ্ছে। সুতরাং এক বিকল্প সাংস্কৃতিক-রাজনীতির চর্চা শুরু করার এটাই প্রকৃষ্ট সময়।

1 comment:

  1. Thanks for the blog and the new website http://www.unishemay.org. Its a great initiative.

    Please provide more information on the website about the people associated with the website.

    Thanks
    Team Silchartoday
    www.silchartoday.com

    ReplyDelete