Thursday, May 20, 2010

উনিশে মে ডট অর্গ

প্রসঙ্গটা উঠে এল হঠাৎই। গত বছর ১৯ মে’র পর কোনো একটা দিন। কলকাতায় আমাদের পাড়ায় বিশিষ্ট গায়ক ময়ূখ আর যাদবপুরের প্রাক্তন ছাত্রকর্মী সৈকতের সাথে কথা বলছিলাম ১৯ মে নিয়ে। বহুবার বরাক উপত্যকায় আসা এবং এখানকার সংস্কৃতিকর্মীদের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে ১৯ মে সম্পর্কে অনেকটাই জানে। আমাদের কথোপকথন শুনে সৈকত ১৯ মে সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞতার কথা বলল। তখনই কথায় কথায় উঠে এল উনিশের শিরোনাম দিয়ে বরাক উপত্যকার ইতিহাস সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি ওয়েব সাইট তৈরির সম্ভাব্যতার বিষয়। সৈকত ওয়েব তৈরির কাজের সাথে যুক্ত, ফলে সেই জিজ্ঞেস করল, কেন আমরা এই বিষয় নিয়ে একটি ওয়েব সাইট তৈরি করছি না। ময়ূখ বরাক উপত্যকার হিতাহিত বিষয়ে সবসময়েই ভাবে। সেও ভরসা দিল এমন একটি কাজ শুরু করা পক্ষে। দূর থেকে আমাদের ধারণা ছিল. একটি ওয়েব তৈরি হয়ত খুবই খরচসাপেক্ষ বিষয়। সৈকতর সাথে কথা বলে বুঝলাম, আমাদের সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক লড়াইয়ের গুরুত্ব যতটা, তার তুলনায় ওয়েব সাইট তৈরির খরচ তেমন আহামরি নয়। বরাক উপত্যকায় স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে একটি ভালো অনুষ্ঠান করতে যা খরচ হয়, একটি ভালো ওয়েব সাইট তৈরির খরচ তার চেয়ে বেশি নয়। আমার বহুদিনের স্বপ্ন ছিল বরাক উপত্যকাকে ওয়েব দুনিয়ায় হাজির করা। হাজির করা বলতে আমাদের সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক লড়াইটাকে যথার্থভাবে ওয়েব দুনিয়ায় নিয়ে আসা। এমনিতে বরাক কেন্দ্রীক যে সাইটগুলি ইতোমধ্যে ওয়েব দুনিয়ায় রয়েছে তাদের কাউকেই ছোট না করে বলতে পারি। এই মুহূর্তে সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক দিক থেকে নেতৃত্বহীনতার এক চূড়ান্ত অবস্থায় রয়েছে বরাক উপত্যকা। তাঁর প্রতিদিনের বেঁচে থাকাটাই একটা সংকট্রে মধ্যে দাঁড়িয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা দিন দিন ভেঙে পড়ছে। সমস্ত ক্ষেত্রে পরিকাঠামো পিছিয়েই যাচ্ছে দিন দিন। রেল স্টেশনের নাম পরিবর্তনের মত একটা সামান্য দাবিও পূরণ হচ্ছে না রাজনৈতিক তঞ্চকতার জন্যে। কেউ চাইছেন এটা করে নাম কিনতে, আর কেউ হয়ত চাইছেন এটা না করে কারো কাছ থেকে প্রশংসা কুড়োতে। মাঝ থেকে বরাক আরো একটি প্রবঞ্চনার শিকার হল। ব্রডগেজ খুড়োর কলের মত আমরা এগোলে আরো দূরে চলে যায়। সবচাইতে বড় সমস্যা। একটি উপনিবেশ যেমন অসহায় থাকে তাঁর মুষ্টিমেয় ধনাঢ্য ব্যক্তির জাঁকজমক আর সংখ্যাগরিষ্ঠের হাহাকার নিয়ে। বরাকেও তাই। এখানে ট্রেন না চললেও ঘোড়ায় চড়ে মন্ত্রপুত্র ঘুরে বেড়ায়। সব কিছু ছাড়িয়ে এই সময়ে বড় হয়ে উঠেছে আমাদের সাংস্কৃতিক অসহায়তা। বাইরের পৃথিবী বরাকের সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অনবহিত। আমরাও বাইরের পৃথিবীর সাথে সেতু তৈরি কোনো চেষ্টা তৈরি করছি না। আমার ভাবলে অদ্ভুত লাগে, আজ অবধি বরাকের ভাষা সংগ্রাম ও তার উত্তরাধিকার নিয়ে কোনো চর্চা উত্তর পূর্ব ভারতের বৃহত্তর গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কোনো উদ্যোগই কেউ নিলেন না। এখানকার সাংস্কৃতিক আন্দোলন একটি আঞ্চলিক রূপ নিয়ে এই অঞ্চলেই টিঁকে আছে। অথচ আমরা বাইরে যাচ্ছি না, তা নয়। কেউ গান গাইতে, কেউ বক্তৃতা দিতে, কেউ কবিতা পড়তে অহরহ যাচ্ছি বাইরে। কিন্তু এখানকার ভাষা সংগ্রাম যে বৃহত্তর উত্তর পূর্বের রাজনীতির প্রেক্ষিতেও যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে, এই বার্তা আজো পৌঁছায় নি বাইরে। অন্য ভাষাভাষীদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি বা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশই জানেন না, এখানকার ভাষা সংগ্রামের প্রকৃত স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য। এঁদের সকলেরই ধারণা, বরাকের বাঙালিরা বহিরাগত, এসেছেন দেশভাগের বলি হয়ে। এখানে এসে স্থানীয় মানুষদের বিতাড়িত করে এখানকার মাটি জল সংস্কৃতি দখল করে নিয়েছেন। বরাকের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের রাজনৈতিক উপস্থাপন বিগত দশকগুলিতে সম্ভবপর হয় নি। দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষমতা দখলের রাজনীতির সাথে এই বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা খুব একটা ছিল না। বামপন্থী দলগুলিও এখানকার মাটির সাথে বামপন্থাকে সম্পৃত্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সংস্কৃতি ও রাজনীতির মেলবন্ধন দু’ধরনের হয়। একটি মেলবন্ধন ঘটায় চরম দক্ষিণপন্থীরা। ধর্ম এবং সংস্কৃতির মধ্যে গুলিয়ে দিয়ে রাজনীতির সাথে এর মিশেল করে তারা মূলত এক ধরনের ফ্যাসীবাদের চর্চা করেন। সাধারণ দক্ষিণপন্থীদের রাজনীতির সবটাই ক্ষমতা দখলকেন্দ্রীক। কোনো বিশেষ মতাদর্শে সমাজকে চালিত করার কোনো দায় এঁদের নেই। সাংস্কৃতিক রাজনীতি বামপন্থীদেরও ঐতিহাসিক দায়। কিন্তু এই রাজনীতির যথার্থ সংজ্ঞায়ন সব সময়ে হয় না। হয় না বলেই দেখা যায় কোনো বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে বামপন্থীরা একটি ছোট্ট বৃত্তের মধ্যেই আটকে থাকে। যেখানে সংজ্ঞায়ন যথার্থ হয় সেখানেই একটি কিউবা, একটি লাতিন আমেরিকা, কিংবা একটি ত্রিপুরার জন্ম হয়। আমাদের অঞ্চলে এর প্রাথমিক ইঙ্গিত থাকা সত্ত্বেও তা ঘটে নি।
উনিশের শিরোনামে এই উপত্যকার ভাষা সংস্কৃতি বিষয়ে ওয়েব সাইট তৈরির বিষয়টির হয়তো প্রত্যক্ষত কোনো সম্পর্ক নেই বলেই মনে হবে কারো। কিন্তু রয়েছে, আমার বিবেচনায়। হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছিলেন এখানেই একটি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়। পৃথিবীর অনেক দেশেই দেখা গেছে, সাংস্কৃতিক আন্দোলন কখনো কখনো রাজনৈতিক আন্দোলনকে ছাড়িয়ে যায়। আমাদের প্রতিবেশি বাংলাদেশ হয়ত তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আমাদের বরাক উপত্যকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও এই জোর রয়েছে। ভোট রাজনীতির বিচিত্রলীলা এই, শহীদের হত্যাকারীও এখানে বিধায়ক হন, আসাম চুক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার বরাকে ওই পটভূমিতেই চুক্তি-সমর্থক দলের প্রার্থীও বিধায়ক নির্বাচিত হয়ে যান। বরাকের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি এখানকার ভোট রাজনীতিতে কখনোই প্রাসঙ্গিক না হয়ে উঠলেও হাজার দুর্বলতা সত্ত্বেও একে জাগরুক রেখেছেন মূলত সংস্কৃতিকর্মীরাই। সংস্কৃতিকর্মী বলতে শুধু গান নাচ যারা করেন তারাই নন। বরাকে যারা বিদ্যাচর্চার সাথে যুক্ত, বিশেষ করে সমাজ বিজ্ঞান ও ভাষা নিয়ে, তাঁরাও প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতিকর্মীই। ফলে সংস্কৃতিকর্মীদের এই ব্যাপ্ত সমাজই প্রকৃতপক্ষে বরাক উপত্যকায় মূল রাজনৈতিক সংগ্রামী। আমাদের কবি দিলীপ লস্করের বহু আলোচিত সেই কবিতা বা কালিকা প্রসাদের এপার বাংলা গানও আসলে একটি রাজনৈতিক উচ্চারণ। এটা বলার অর্থ এটাও নয় যে, এই সংস্কৃতি অঙ্গনে সব ভালোয় ভালোয় চলছে। ভোট-রাজনীতির নোংরা জল আমাদের এখানেও একটু একটু করে ঢুকছে। সেজন্যেই ইস্যু নির্মাণ ও ইস্যু কবর দেওয়ার মতো হীন রাজনৈতিক কাজটিও মাঝে মাঝে সংস্কৃতি অঙ্গন থেকেই হচ্ছে।
এই পটভূমিতেই উনিশে মে ডট অর্গের ভাবনার জন্ম। বাঙালিবৃত্ত ছাড়িয়ে বৃহত্তর অ-বাংলা সমাজের কাছে আমাদের বার্তা পৌঁছে দিতে গোটা সাইটকে ইংরেজি ও বাংলায় তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেহেতু আমাদের সংস্কৃতি রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক বেশি ভাবে হয়ে আছে অন্য অঞ্চলের তুলনায়, তাই রাজনীতি সম্পর্কে নিবন্ধও এই ওয়েব সাইটের বিষয়। আবার যে ভূগোলের কথা বলব, তা যে ইতিহাসের সাথে দ্বন্দ্ব সমাসে বিরাজ করছে সেই কবে থেকেই, তাই ভূগোলের কথা বলতে গিয়ে অবধারিতভাবে এসেছে ইতিহাসের প্রসঙ্গ। থাকছে আমাদের কবিতা গল্প নাটক নাগরিক ও লোকগান. প্রতিবেশিভাষার সংস্কৃতির উপাদান।
এবারের উনিশের সন্ধ্যায় শিলচরের জেলা গ্রন্থাগার মঞ্চে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চের অনুষ্ঠানে এর উন্মোচন করেছেন আমাদের উপত্যকার রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগ্রামের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি, সংস্কৃতিকর্মীদের মাতৃস্বরূপা শ্রদ্ধেয় অনুরূপা দি, অনুরূপা বিশ্বাস। কৃষক শ্রমিক সহ সাধারণ মানুষের গণআন্দোলন থেকে সাংস্কৃতিক সংগ্রাম বইছে তাঁর ধমনীতে। শিলচরের জেলা গ্রন্থাগার মিলনায়তনে প্রায় সাড়ে সাতশো মানুষের উপস্থিতিতে উন্মোচিত হয়েছে উনিশে মে ডট অর্গ আনুষ্ঠানিকভাবে। সেদিনের অনুষ্ঠানে যাঁরা ছিলেন তারা তো বটেই, বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় যাঁরা আসতে পারেন নি. তারাও ই-মেলে বার্তা পাঠিয়ে, ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ভরসা দিয়েছেন পাশে থাকার। সাংস্কৃতিক সংগ্রাম যেমন একটি বহমান বাস্তবতা, তেমনি ওয়েব সাইটও একটি নিয়ত বহমান। এই মুহুর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, উনিশের সন্ধ্যায় সফল যাত্রারম্ভের আত্মপ্রসাদ নয়। আরো বহু বহু উনিশ এঁকে বাঁচিয়ে রাখা। এটা কখনো একটি ছোট্ট গোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমাদের স্বপ্ন, এই ওয়েব সাইটের সাথে যুক্ত ব্লগ, উনিশেমে ডট ব্লগস্পট ডট কমের মাধ্যমে এই উদ্যোগের সাথে যুক্ত হোক হাজার হাজার মানুষ। বরাক উপত্যকার শুধু বাঙালি নয়, নানা জনগোষ্ঠীর মানুষের স্বপ্ন ও সংগ্রাম, তাঁদের সৃজন জগৎ প্রকাশিত হোক এই ওয়েব সাইটের মাধ্যমে। ভারতের উত্তর পূর্ব অংশের সামাজিক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে অবস্থিত এই বাঙালি জনপদ যে বহুত্বের সাধনা করে আসছে সেই কবে থেকে তা মূর্ত হয়ে উঠুক উনিশে মে ডট অর্গের পাতায় পাতায়।

2 comments:

  1. আমি শিলচরের খুব কাছেই বাংলাদেশের সিলেটে থাকি। বছর তিনেক আগে শিলচরের ভাষা আন্দোলনের কথা, ১৯ মের ঘটনা জানতে পারি । আমাদের এখানেও অনেকেই জ্ঞাত নন এই বিষয়ে। ওয়েবসাইট হলে সহজেই মানুষজন জানতে পারবে, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানও ঘটবে।

    আপনাদের উদ্যোগের সাফল্য কামনা করি ও সাধুবাদ জানাই।



    একুশ তাপাদার
    সিলেট, বাংলাদেশ

    ReplyDelete
  2. শুভ দা,
    লেখাটির জন্য ধন্যবাদ। ওয়েব সাইটটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে শুভেচ্ছা।
    রক্ত দিয়ে অর্জিত বর্ণমালা বাংলা। একে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সকলের।

    বাংলার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছে বিশ্বময়, সবার জন্য অনন্ত শ্রদ্ধা।

    ফয়সল
    ঢাকা, বাংলাদেশ

    ReplyDelete